মো. আব্দুল মান্নান :
ঈমান আমলের সাথে থেকে কুরআনের খেদমতে নিজেকে বিলিয়ে দিতে চান ক্বারী শামসুল ইসলাম দামাত বারাকাতুহুম। স্কুল থেকে ওঠে আসা ক্বারী শামসুল ইসলামকে আল্লাহ তায়ালা তার দীনের জন্য, দীনের খেদমতের জন্য তিনি কবুল করে নিয়েছেন। কথা বলে জানা যায়, ক্বারী সাহেব হুজুরের গ্রামের বাড়ি ময়মনসিংহের ফুলপুর উপজেলার বওলা ইউনিয়নের হাতিবান্ধা গ্রামে। উনার আব্বাজানের নাম মরহুম শাহাবুদ্দীন আর আম্মার নাম সালেহা খাতুন। উনারা ৪ ভাই ও ২ বোনের মধ্যে তিনি সবার বড়। তার হাতে খড়ি হয় পূর্বধলা কালিহর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। ওই বিদ্যালয় থেকে তিনি ৫ম শ্রেণি পাস করেছেন। এরপর বওলা স্কুল ও বালিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছেন তিনি। বালিয়া উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ১৯৭৬ সনে কৃতিত্বের সাথে এসএসসি পাস করেন ক্বারী শামসুল ইসলাম। তারপর ফুলপুর ডিগ্রি কলেজে ভর্তি হন। সেখান থেকে তিনি ইন্টারমিডিয়েট ও ডিগ্রি পাস করেন। এর আগে ত্রিশালের একটি মাদরাসা থেকে তিনি ক্বেরাত পড়েন। উনার ক্বেরাতের উস্তাদ ছিলেন ময়মনসিংহ রাহাতুল জান্নাত মহিলা মাদরাসার মুহতামিম ইত্তেফাকুল উলামা মোমেনশাহী-এর সাধারণ সম্পাদক পীরে কামেল আলহাজ্ব মাওলানা আবুল কালাম আজাদ সাহেবের শ্বশুড় ক্বারী আব্দুল হালিম সাহেব। তারপর বৃহত্তর মোমেনশাহীর ঐতিহ্যবাহী ক্বওমী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জামিয়া আরাবিয়া আশরাফুল উলূম বালিয়ায় কিতাবখানায় ভর্তি হন তিনি। পরে বালিয়া থেকে তিনি নাহবে মীর পাস করেন। এমতাবস্থায় উনার আব্বাজান ইন্তেকাল করেন। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিঊন।

পরে মাইজবাড়ির কৃতি সন্তান আল্লাহর ওলী শায়খুল হাদীস আল্লামা খালেদ সাইফুল্লাহ সাদী সাহেবের আব্বাজান জামিয়া আরাবিয়া মাখযানুল উলূম, তালতলা মাদরাসার তৎকালীন সভাপতি মরহুম পীরে কামেল হযরত মাওলানা আরিফ রব্বানী হুজুর উনাকে তালতলা মাদরাসায় ক্বেরাত পড়ানোর জন্য নিয়ে যান। সেখানে ক্বেরাতের উস্তাদ হিসেবে যোগদান করে দারুল হাদীস জামাতসহ বিভিন্ন জামাতে তিনি ক্বেরাত পড়ান। এখানে কেটে যায় উনার জীবনের ২০টি বছর। ২০ বছর পর ফুলপুর আদর্শ মাদরাসার নায়েবে মুহতামিম পদে দায়িত্ব পালনের জন্য মাদরাসার মহাপরিচালক মাওলানা আবু রায়হান মক্কী সাহেব উনাকে ময়মনসিংহ থেকে ফুলপুরে নিয়ে আসেন। জানা যায়, রায়হান সাহেবের মা উনার নানীর বোন। সেই সূত্রে রায়হান সাহেব উনার মামা হন। মামার আবদার রক্ষার্থে ফুলপুরে উনার কেটে যায় আরও ২২ বছর। এ সুদীর্ঘ জীবনে তাকে নানা ঘাত প্রতিঘাত সহ্য করেই টিকে থাকতে হয়েছে। ২টি প্রতিষ্ঠানে জীবনের ৪২টি বছর ইস্তেক্বামাতের সাথে কাটিয়ে দেওয়া চাট্টিখানি কথা নয়। ২শ বা ৫শ টাকা বাড়তি পাওয়ার অফার পেলেই আজকাল ‘বাড়িতে বিরাট সমস্যা। চাকরি করা যাবে না’ বলে অন্য প্রতিষ্ঠানে গিয়ে যোগদান করেন। এমন লোকও আছে। কিন্তু নির্লোভ আল্লাহর ওলী ক্বারী শামসুল ইসলাম ছিলেন এর সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী। এসব প্রলোভনে কেউ কখনো টলাতে পারেনি তাকে। দুটি মাদরাসারই গোড়ার দিকের উস্তাদ ছিলেন তিনি। গোড়ার উস্তাদরাই গড়েন প্রতিষ্ঠান। তখনের কারিগররা ছাত্র গড়ার পাশাপাশি, পরিশ্রমী, তাহাজ্জুদগুজার ও সার্বিক বিষয়ে ভালো না হলে গড়ে ওঠে না প্রতিষ্ঠান। ভেঙেচুরে যায়। অথচ ক্বারী শামসুল ইসলাম সাহেব যে দুটি প্রতিষ্ঠানের গোড়ার দিকে মেহনত করেছেন সে দুটি প্রতিষ্ঠানই গড়ে ওঠেছে; শক্ত ও মজবুতভাবে দাঁড়িয়েছে সগৌরবে। তিনারা হকের উপর ইস্তক্বামাতের সাথে অটল অবিচল থেকে নিবেদিত প্রাণ হয়ে নিজের প্রতিষ্ঠান মনে করে দায়িত্ব পালন করেছেন বলেই প্রতিষ্ঠানগুলো আজ মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত।

ফুলপুর সরকারি কলেজ রোডে ‘এক্সিলেন্ট স্কুল অ্যান্ড মাদরাসা’ নামে আমার একটি প্রতিষ্ঠান ছিল। এ উপলক্ষে বিভিন্ন সভা সমাবেশে বা অনুষ্ঠানে ক্বারী শামসুল ইসলাম সাহেবের সাথে দেখা হতো, কথা হতো। তিনি আমাদের প্রতিষ্ঠানে আসতেন। আমিও উনার আদর্শ মাদরাসায় যেতাম। এভাবে উনার সাথে সখ্যতা গড়ে ওঠে। যতবার উনার সাথে দেখা হয়েছে প্রতিবারই উনার ব্যবহারে মুগ্ধ হয়েছি। ভুলা যায় না মানুষটিকে। তিনি হাজারো ছাত্রের উস্তাদ। উস্তাযুল আসাতিযা। কিন্তু কোন রিয়া, অহংকার বা দেমাগ নেই। অত্যন্ত আমানতদারীর সাথে দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। অতি সাদাসিধে জীবন তার। লুঙ্গি পড়েন। গোল পাঞ্জাবি, পাগড়ি পড়েন। মাথার চুল থেকে পায়ের পাতা পর্যন্ত সুন্নাতি লেবাস। আসলে আল্লাহর ওলীরা এমনই হন। ফুলপুর নয় শুধু বরং ময়মনসিংহের শীর্ষ উলামায়ে কেরাম সবাই তাকে চিনেন।
আমি হুজুরকে মহব্বত করি। তিনিও আমাকে আদর করেন। সম্প্রতি তালতলা এলাকায় সিলভার ক্যাসল রিসোর্ট সংলগ্ন ট্যানারি মসজিদে তিন দিনের তাবলীগ জামাতে গেলে মাখযান মাদরাসায় আল্লাহর ওলী আল্লামা আব্দুর রহমান হাফেজ্জী হুজুরের কক্ষে উনার সাথে দেখা হয়। পরে তিনি আমাদেরকে অর্থাৎ বীর মুক্তিযোদ্ধা রহিমগঞ্জ ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান আব্দুস সালাম আকন্দ প্রিন্স, কাজিয়াকান্দা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আইয়ুব আলী, ডিপিএস মডেল একাডেমির প্রধান শিক্ষক হুমায়ুন কবির, মাওলানা রাকিবুল হাসান, মাওলানা সাকিবুল হাসান ও মুফতী মাহমুদুল হাসানসহ বেশ কয়েকজনকে মাখযান মাদরাসা সংলগ্ন উনার নিজস্ব বাসায় নিয়ে যান। বহুত আদর আপ্যায়ন করেছেন। আল্লাহ তায়ালা উনাকে জাযায়ে খায়ের দান করুক।

আল্লাহর এই ওলী ক্বারী শামসুল ইসলাম ১৯৬০ সনের ১ ফেব্রুয়ারি জন্ম গ্রহণ করেছেন। তিনি পরিবারের সদস্যদের প্রতিও ছিলেন অত্যন্ত যত্নশীল। উনার আব্বাজান মারা যাওয়ার পর ভাই বোনদের পড়াশোনা করানোসহ যেসব দায়িত্ব ছিল তা তিনি পালন করেছেন। শুনেছি, ময়মনসিংহ গলগন্ডা মহিলা মাদরাসার মুহতামিম মাওলানা জামাল উদ্দিন সাহেব উনার ভাতিজা হন এবং তিনিই তাকে ময়মনসিংহে এনে মাখযানে ভর্তি করে পড়াশোনা করিয়েছেন। ময়মনসিংহে তিনি ‘খান সাহেব হুজুর’ ও ফুলপুরে ‘ক্বারী সাহেব হুজুর’ হিসেবে পরিচিত। আলহামদুলিল্লাহ, উনার আম্মাজান এখনো বেঁচে আছেন। তিনি মুক্তাগাছার মালতিপুর আলিয়া মাদরাসার উস্তাদ মাওলানা কুতুব উদ্দিন সাহেবের মেয়ে মমতাজ বেগম পারুলকে বিবাহ করেন। ব্যক্তি জীবনে তিনি দুই পুত্র ও দুই কন্যা সন্তানের জনক। বড়ছেলে আন্তর্জাতিক হাফেজ মাওলানা আব্দুল্লাহ আল মাবরুর। তিনি রাষ্ট্রীয়ভাবে কাতার ধর্ম মন্ত্রণালয় কর্তৃক ২০১৭ সনের ১৬ জুলাই নিয়োজিত হয়ে ৮ বছর যাবৎ সেখানে একটি মসজিদের খেদমত আঞ্জাম দিচ্ছেন। বিয়েসাদীও সেখানেই করেছেন। দুই সন্তানের জনক। আর ছোট ছেলেও আন্তর্জাতিক হাফেজ মাওলানা ও মুফতী নেয়ামাতুল্লাহ মাসরুর। তিনিও বর্তমানে কাতারে রয়েছেন। ক্বারী শামসুল ইসলাম সাহেবের প্রথম কন্যা দাওরা পাস। উনাকে ফুলপুর কাসেমুল উলূম মাদরাসার মুহতামিম ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ -এর ফুলপুর উপজেলা শাখার সভাপতি ঢাকা উত্তরার একটি মসজিদের খতীব মুফতী নজরুল ইসলাম সাহেবের নিকট বিয়ে দিয়েছেন। আর ছোট কন্যা হাফেজা। উনাকে বিয়ে দেওয়া হয়েছে মুফতী তানভীর হাসান তাসনীমের কাছে। সবমিলিয়ে অনেক সুখি সমৃদ্ধ ইসলামী পরিবার উনার। বর্তমানে তিনি মসজিদ আর বাসায়ই সময় কাটাচ্ছেন। উনার সাথে কথা বললে এ প্রতিবেদককে বলেন, এখন শরীরও বেশি ভাল যাচ্ছে না। ঈমান আমলের সাথে থাকতে চাই। আবারও ধারে কাছে কোথাও কুরআনের খেদমতের সুযোগ আল্লাহ তায়ালা করে দিলে কুরআনের খেদমতে নিজেকে বিলিয়ে দিতে চাই। খেদমত করতে করতে মরতে চাই। সবাই আমার জন্য দোয়া করবেন।