আজ
|| ১২ই নভেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ || ২৭শে কার্তিক, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ || ২০শে জমাদিউল আউয়াল, ১৪৪৭ হিজরি
মরহুম মাওলানা আব্দুল মাজিদ জিহাদি ছিলেন বিপ্লবী এক শিক্ষক ও প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর
প্রকাশের তারিখঃ ২০ আগস্ট, ২০২৫
মাওলানা জিহাদ মোহাম্মদ :
মরহুম মাওলানা আব্দুল মাজিদ জিহাদি ছিলেন বিপ্লবী এক শিক্ষক ও প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর। ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট উপজেলার ধারা বাজারের পশ্চিম পাশে অবস্থিত জামিয়া হুসাইনিয়া দারুল উলুম মাঝিয়াইল মাদ্রাসার উস্তাদ ছিলেন তিনি। তিনি আসলে শুধু একজন উস্তাদ বা শিক্ষক ছিলেন না বরং তিনি ছিলেন একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। যেনো একটি আদর্শের বাতিঘর। যেনো একটি উজ্জ্বল নক্ষত্র। তিনি ছিলেন একজন বিপ্লবী নেতা। একজন যোদ্ধা। তার কথাবার্তা, বয়ান ও সার্বিক কর্মকাণ্ডের দ্বারা তিনি 'জিহাদি' নামে পরিচিতি লাভ করেছিলেন। লোকেরা তাকে 'জিহাদি হুজুর' হিসেবেই চিনতো। অন্যায়ের বিরুদ্ধে তার আপসহীন প্রতিবাদের কারণেই লোকেরা তাকে এ 'লক্বব' দেন।
মাওলানা আব্দুল মাজিদ জিহাদি তার প্রাথমিক শিক্ষা নিজ গ্রামেই সম্পন্ন করেন। এরপর উচ্চতর ধর্মীয় শিক্ষার জন্য তিনি পাড়ি জমান ঢাকার যাত্রাবাড়ীতে জামিয়া ইসলামিয়া দারুল উলূম মাদানিয়া মাদ্রাসায়। সেখান থেকে তিনি দাওরায়ে হাদিস সম্পন্ন করেন। গভীর জ্ঞান ও প্রজ্ঞা নিয়ে তিনি ফিরে আসেন তার প্রিয় প্রতিষ্ঠান জামিয়া হুসাইনিয়া দারুল উলুম মাঝিয়াইল মাদ্রাসায়। এখানে তিনি ছাত্রদেরকে কেবল ধর্মীয় জ্ঞান দান করেই ক্ষান্ত হননি, তিনি তাদের হৃদয়ে গেঁথে দিয়েছিলেন সততা, সাহস আর ন্যায়ের বীজ। তিনি শেখাতেন- কীভাবে অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হয়, কীভাবে অসহায় ও বঞ্চিত মানুষের পাশে দাঁড়াতে হয়। তার কণ্ঠ ছিল দুর্বলদের জন্য এক শক্তি আর অন্যায়কারীদের জন্য এক তলোয়ার। তিনি অন্যায় সহ্য করতে পারতেন না; প্রতিবাদ ছিল তার স্বভাবের অংশ।
দীর্ঘদিন ধরে তিনি এই মাদ্রাসায় সুনামের সাথে শিক্ষকতা করে গেছেন। তার শিক্ষা ছিল জীবনমুখী, যা কেবল পুঁথিগত বিদ্যার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। তার শিক্ষার্থীরা ধর্মীয় অনুশাসনের পাশাপাশি সমাজের প্রতি তাদের দায়িত্ব সম্পর্কেও সচেতন হয়ে উঠতো। তারা দেখতো, তাদের শিক্ষক কেবল মুখের কথায় নয় বরং নিজের জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে সেই আদর্শ বাস্তবায়ন করে চলেছেন।
মাওলানা আব্দুল মাজিদ জিহাদি একবার ৯ নং ধারা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান পদে নির্বাচন করেছিলেন। মানুষের বিপুল ভালোবাসা এবং জনসমর্থন ছিল তার পক্ষে। এই ভালোবাসা ছিল তার আদর্শের প্রতি মানুষের আস্থার প্রতিফলন। এই নির্বাচনে তার সততা ও সরলতার এক অনন্য দৃষ্টান্ত ছিল যে- তিনি মাত্র ১৭ টাকা খরচ করেছিলেন। যা আধুনিক নির্বাচনী প্রচারণার জন্য প্রায় অবিশ্বাস্য। এই সামান্য খরচই প্রমাণ করে তিনি মানুষের সমর্থন চেয়েছিলেন আদর্শের জোরে, টাকার জোরে নয়। নির্বাচনের দিন ব্যালট বাক্সে তার মার্কাতে যে বিপুল ভোট পড়েছিল তা প্রমাণ করে সাধারণ মানুষ তাকে কতটা ভালোবাসতো এবং তাদের নির্বাচিত প্রতিনিধি হিসেবে কতটা চাইতো। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, ভোট চুরি আর কারচুপির কাছে হেরে যায় মানুষের ভালোবাসা। তার জয়লাভ না করাটা কেবল একজন ব্যক্তির পরাজয় ছিল না, ছিল আদর্শের পরাজয়। মানুষের গভীর ভালোবাসা ও আস্থার করুণ পরিণতি।
মাওলানা আব্দুল মাজিদ জিহাদি হয়তো চেয়ারম্যান হতে পারেননি কিন্তু তিনি মানুষের হৃদয়ে যে সম্মানের আসনে অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন তা কোনোদিন কোন পদ-পদবির দ্বারা সম্ভব নয়। তিনি প্রমাণ করে গেছেন, প্রকৃত বিজয় ক্ষমতার মসনদে বসা নয় বরং মানুষের হৃদয়ে চিরন্তন শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার স্থান করে নেওয়াই প্রকৃত বিজয়। তিনি তার আদর্শ ও সংগ্রামের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকা অবস্থায় ২০১৩ সালে আল্লাহর ডাকে সাড়া দিয়ে এই পৃথিবী ত্যাগ করেন। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিঊন। তাকে তার প্রিয় শিক্ষাঙ্গন, জামিয়া হুসাইনিয়া দারুল উলুম মাঝিয়াইল মাদ্রাসার মাকবারাতেই সমাহিত করা হয়েছে।
তিনি একজন বিপ্লবী শিক্ষক হিসেবে চিরকাল আমাদের অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে থাকবেন। তার জীবন আমাদের শেখায়, অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ কখনো বৃথা যায় না আর আদর্শের জন্য লড়াই করা একজন মানুষের জীবনের সবচেয়ে বড় ধর্ম।
লেখক: জিহাদি হুজুরের সাহেবজাদা।
Copyright © 2025 দৈনিক বাংলাদেশ নিউজ. All rights reserved.