আজ
|| ১৩ই নভেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ || ২৮শে কার্তিক, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ || ২১শে জমাদিউল আউয়াল, ১৪৪৭ হিজরি
ফুলপুরে ঈদের দিন সড়কে নিহত নওমুসলিম মোতালেবের পরিবারের আজও খবর নেয়নি কেউ
প্রকাশের তারিখঃ ৯ জুন, ২০২৫
মো. আব্দুল মান্নান :
ময়মনসিংহের ফুলপুরে পবিত্র ঈদুল আজহার দিন শনিবার (৭ জুন) সকাল সাড়ে ৫টার দিকে ফুলপুর-শেরপুর মহাসড়কে উপজেলা প্রাণিসম্পদ দপ্তর ও ভেটেরিনারি হাসপাতালের সামনে ঝিনাইগাতি থেকে ছেড়ে আসা ঢাকামুখী পলি পরিবহনের একটি বাস (ঢাকা মেট্রো -ব ১২-১১৪২) রংসাইডে গিয়ে অটোচালক নওমুসলিম আব্দুল মোতালেবের অটোর উপরে উঠিয়ে দেয়।

বাস অটোরিকশাটিকে নিচে ফেলে একদম পিষে ফেলে। টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যায় অনেকটা। এতে ঘটনাস্থলেই মারা যান আব্দুল মোতালেব (৪০)। আব্দুল মোতালেব ফলের একটি ট্রিপ নিয়ে ফুলপুর থেকে ভাইটকান্দি গিয়েছিলেন। সেখান থেকে ফেরার সময় এ দুর্ঘটনার কবলে পড়েন তিনি।

জানা যায়, আব্দুল মোতালেব একজন নওমুসলিম। তিনি ফুলপুর পৌরসভার গোদারিয়া গ্রামের গগন চন্দ্র সরকার ও অঞ্জলি রানী সরকারের পুত্র ছিলেন। পরে একই গ্রামের মজনু মিয়া ও ফুলজান বিবির কন্যা পারভীনের সাথে তার প্রেমের সম্পর্ক গড়ে উঠলে ওই সম্পর্ককে স্থায়ী রূপ দিতে তিনি স্বেচ্ছায় সজ্ঞানে প্রেমিকার ধর্ম ইসলাম গ্রহণ করেন ও পারভীনকে বিবাহ করেন। ইসলাম গ্রহণের পর থেকে তিনি নামাজ পড়তেন।
তাবলীগেও গিয়েছিলেন। ঈমান আমল শেখার জন্য সময় লাগিয়েছেন। ঘটনার দিন শুনেছি, তিনি ঈদের নামাজ আদায়ের প্রস্তুতি নিয়েই বের হয়েছিলেন। সময় হলে পথেই যাতে ঈদের নামাজটা আদায় করে নিতে পারেন এর জন্য জামাকাপড় সঙ্গে করে নিয়ে গিয়েছিলেন তিনি।

স্থানীয়দের সাথে কথা বললে নারী পুরুষ সবাই তার ভুয়সী প্রশংসা করেন। মোতালেবের পার্শ্ববর্তী আনোয়ার খিলা গ্রামের সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব অভিনেতা স্বাধীন ওরফে টাইসন বলেন, পথেঘাটে পাইলে তার অটো দিয়ে আমাদেরকে ফুলপুর নিয়ে যেতেন। ভাড়া দিতে চাইলে কখনো তিনি ভাড়া নিতেন না। খুব ভালো একজন মানুষ ছিলেন। তার প্রতিবেশী মুরুব্বি সেকান্দর আলী বলেন, সে আমাদের চেয়ে ভালো নামাজী ছিল। নম্রভদ্র ছিল। গাড়ি চালাতো। নিজের জায়গা জমি না থাকায় বিভিন্ন জায়গায় ভাড়ায় থাকতো।

মোতালেবের আগের নাম ছিল রঞ্জন। ইসলাম গ্রহণের পর নিজ পিতা মাতার সম্পদ থেকে বঞ্চিত হয়ে ভাড়া বাড়িতে বসবাস করে আসছিলেন তিনি। মৃত্যুর সময় তিনি স্ত্রী ও তিনজন সন্তান রেখে গেছেন। সন্তানরা সবাই খুব ভালো। প্রথমেই উনার একজন কন্যা সন্তান জন্ম নেয়। ওর নাম প্রান্তি (১৮), দ্বিতীয়ত ছেলে। ওর নাম ওলীউল্লাহ (১৫) ও তৃতীয় সন্তান মেয়ে মীম (১৩)।
আজ সোমবার (৯ জুন) সকাল ৬টার দিকে নওমুসলিম মোতালেবের পরিবারের সদস্যদের খোঁজ খবর নিতে গোদারিয়া গ্রামে সরেজমিন পরিদর্শনে গেলে কথা হয় মুরুব্বি সেকান্দর, বাড়িওয়ালা হেলাল উদ্দিন ও হাফেজ মাহদী হাসানসহ অনেকের সাথেই। তারা সবাই মোতালেবের প্রশংসা করেন। বলেন যে, 'ছেড়াডা ভালা আছিন।'
পরিবারের সদস্যদের হালাত জানতে চাইলে তার প্রথমা কন্যা প্রান্তি জানায়, সে মোমেনশাহী কলেজে ইন্টারমিডিয়েটে পড়ে। দুটি প্রাইভেট বাবদ ১০০০ করে ২০০০ টাকা, কলেজের বেতন ৭০০ টাকা, মেচ ভাড়া ১৬০০ টাকা ও অন্যান্য আরও কিছু খরচ প্রতি মাসে তার বাবা তাকে দিতেন। কিন্তু এখন যে আব্বু মারা গেছেন, এখন আমারে খরচ দিবে কে? এসব কথা বলার সময় তার চোখ ছলছল করে ওঠে। ওলীউল্লাহ ফুলপুর পাইলট মডেল সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়ে আর মীম আশরাফুল মডেল একাডেমিতে ৭ম শ্রেণিতে পড়ে। ওদেরও প্রতি মাসে পড়াশোনা বাবদ মিনিমাম ১০০০ করে ২০০০ টাকা খরচ আছে। আর তারা বর্তমানে গোদারিয়া মাদরাসা রোডে হেলাল উদ্দিনের বাড়িতে ভাড়ায় থাকেন। এখানে ঘরভাড়া প্রতি মাসে ৩০০০ টাকা দিতে হয়। আর গ্যাস বিল, কারেন্ট বিল ও খানা খরচ তো আছেই। সবমিলিয়ে এই পরিবারের মাসিক ভালো একটা খরচ আছে। যা মোতালেব অটোরিকশা চালিয়ে যোগাড় করতেন। কিন্তু এখন কীভাবে হবে তাদের খরচের ব্যবস্থা! এসব কথা বলে কাঁদছিলেন পারভীন।

অশ্রুসিক্ত নয়নে পারভীন বলেন, মোতালেব যে অটোরিকশাটি চালাতেন এটি বাসের নিচে পড়ে একেবারে বিধ্বস্ত হয়ে গেছে। এর কিস্তির টাকা এখনো বাকি রয়ে গেছে। জানা যায়, এটি কিস্তিতে ৮০ হাজার টাকায় একজনের নিকট থেকে ক্রয় করেছিলেন। এখনো প্রায় ৪০ হাজার টাকা কিস্তি বকেয়া রয়ে গেছে। মোতালেব নওমুসলিম হওয়ায় পিতামাতার সম্পদ থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। তাছাড়া তার শ্বশুর মজনু মিয়াও গরিব মানুষ; একজন দিনমজুর। শ্বশুরের তিন-চার শতাংশ জমির উপরে টিনের একটি বাড়ি আছে। উনার বাড়ি ভিটাটাই একমাত্র সম্বল। এমতাবস্থায়, সড়কে নিহত নওমুসলিম আব্দুল মোতালেবের স্ত্রী পারভীন কোথায় থাকবেন? বাবার বাড়িতে থাকার ঘর নেই। বাবার আশ্রয়ে থাকতে চাইলে সেখানে একটি ঘর দরকার। আবার ভাড়া বাসায় থাকলেও ভাড়া দিবেন কেমনে? চোখে তিনি কোন পথ দেখতে পাচ্ছেন না। চতুর্দিকে অন্ধকার লাগছে তার। বর্তমানে চার সদস্য বিশিষ্ট পরিবারের খাওয়াদাওয়া বা সন্তানাদির পড়াশোনার খরচ সামলাবারও তার নেই কোন বন্দবস্ত। এমতাবস্থায় স্থানীয় প্রশাসন ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দসহ সরকারের উর্ধতন কর্মকর্তা ও বিত্তবানদের সুদৃষ্টি কামনা করেছেন পারভীন আক্তার।
* ইনসেটে টুপি পরিহিত নওমুসলিম আব্দুল মোতালেব।
Copyright © 2025 দৈনিক বাংলাদেশ নিউজ. All rights reserved.